ভূমিকা──CTO-র এক কথা যে রক্ষা করেছিল

পেশাজীবনে ঢোকার কিছুদিনের মধ্যেই আমাকে প্রথম “দগ্ধ প্রকল্প”-এ ঢুকিয়ে দেওয়া হলো। ডেডলাইন ঘনিয়ে আসছে, অথচ লাগাতার নতুন নতুন চাহিদা আসছে; সরাসরি বস থাকা PM প্রতিটা অনুরোধেই সাড়া দেওয়ার চেষ্টা করছেন। PM নিজে সপ্তাহের অর্ধেক রাত জেগে কাজ করছেন, প্রায় নবীন আমি-ও সপ্তাহে একবার অলনাইটার করছি, সপ্তাহান্তেও অফিস—একেবারে “শেষ না হওয়া কাজ”।

সেই সময়, তখনকার কোম্পানির CTO—যাকে আমি বিরলভাবে “এই মানুষটা সত্যিই পারেন” বলে সম্মান করতাম—আমাকে দেখে বলেছিলেন,

“কাজ তো ডেডলাইন এলেই শেষ হয়ে যায়, তাই একটু স্বস্তিতে থাকো।”

প্রথমে কথা বুঝিনি, কিন্তু শেষমেশ এই বাক্যই আমার মনকে দীর্ঘদিন ধরে ধরে রেখেছে। এটি নিছক সান্ত্বনা বা মজা ছিল না; কাজের আসল সারবস্তুতে আঘাত করা কথাই ছিল।


উপরিতলের অর্থ──ডেডলাইন অবশ্যই আসে

“কাজ ডেডলাইন এলেই শেষ হয়” কথাটা আগে একটি সরল সত্য বলে।

  • যেকোনো কাজেরই সময়সীমা আছে। যদি সময়সীমা ঠিকই না করা হয়, তাহলে সেটি হয়তো করতেই হবে না।
  • সময়সীমা এলে কাজ অনিবার্যভাবে “শেষ” হয়।

তবে সেই “শেষ” একরকম নয়।

  1. নির্ধারিত সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করে শেষ করা।
  2. সম্পন্ন না করে সময় ফুরিয়ে শেষ হওয়া।← “গেম ওভার… মাথায় বাজ পড়ার মতো ধাক্কা” বলতে যা বোঝায়।

ডেডলাইন ফলাফল নিশ্চিত করে না; এটি আসলে “জোর করে রেখা টেনে দেওয়ার ব্যবস্থা”। “শেষ হবে না” বলে মনে হলেও সময় শেষ পর্যন্ত এসে পড়ে।


আসল অর্থ──মনের সুরক্ষার দর্শন

এ পর্যন্তই এক দিক থেকে কাজের সত্য। কিন্তু বাক্যটির হৃদয় আসলে আরও গভীরে ছিল।

ডেডলাইন বাড়ানো যায়। বারবার স্থগিত হয়ে কাজ “শেষ না হওয়া” বলে মনে হতে পারে। তবু, শেষ পর্যন্ত কোনো না কোনোভাবে শেষ হয়। অনন্ত কাজ বলে কিছু নেই।

তাই মৃত্যু-পর্যন্ত ওভারটাইম করারও প্রয়োজন নেই, মনকে ভেঙে জীবন বিসর্জন দেওয়ারও নয়।

কাজ বলে জিনিসটা ফল হোক বা না হোক, শেষ পর্যন্ত কখনও না কখনও শেষ হয়।

এই সত্য মেনে নেওয়াই মনকে একটু ফাঁকা জায়গা দেয়। “আমাকে ভেঙে পড়েই হোক শেষ করতে হবে” এমন ভাবনায় ডুবে থাকা দরকার নেই। বরং স্বস্তি থাকলেই ঠাণ্ডা মাথায় সিদ্ধান্ত নেওয়া যায়, ডেলিভারির মান বাড়ে, মানসিক ভারসাম্যও বজায় থাকে, আর শেষ পর্যন্ত ভালো “শেষ” পাওয়ার সম্ভাবনা বাড়ে।


শেষ আছে বলেই শুরু করা যায়

“অবশ্যই শেষ হবে” তা জানলেই মানুষ কাজ শুরু করতে পারে। ম্যারাথনে গন্তব্য আছে বলেই দৌড়ানো যায়; কাজেও গন্তব্য থাকে বলেই চ্যালেঞ্জ নেওয়া যায়।

  • লক্ষ্য থাকলেই পরিশ্রমের মূল্য পাওয়া যায়।
  • সীমা থাকলেই পরবর্তী চ্যালেঞ্জে যাওয়া যায়।
  • ডেডলাইন থাকলেই কাজ জীবনকে গ্রাস করে না।

দগ্ধ প্রকল্পে আমি বুঝেছিলাম, “যে কাজ শেষ হবে না বলে মনে হয়, তারও শেষ আছে; শেষ আছে এই বিশ্বাসে এগোনোই শেষে সবচেয়ে ফলপ্রসূ”। অবশ্যই এতে কাজের সাফল্য নিশ্চিত হয় না। ক্লায়েন্ট বা বস নিন্দা করতে পারেন, কখনও হয়তো মামলা পর্যন্ত হতে পারে।

কিন্তু সেসব একা বয়ে মন খারাপ করে বসে থাকলে বরং ক্ষতিই বাড়ে।


আমাদের করণীয় হলো “মনকে অবকাশ” রাখা

CTO বলেছিলেন “কাজ ডেডলাইন এলেই শেষ হয়”—এটি শুধু সান্ত্বনা ছিল না।

  • যতই কঠিন হোক, কাজ শেষ হবে।
  • তখন কী রেখে যেতে পারব তা পরিস্থিতির উপর নির্ভর করবে।
  • কিন্তু যদি মনকে অবকাশ দেওয়া যায়, অতিরিক্ত কষ্ট বা মানসিক অসুস্থতা থেকে বাঁচার সম্ভাবনা বাড়ে, আর ভালোভাবে শেষ করার সুযোগও বিস্তৃত হয়।

অর্থাৎ আমাদের যা করতে হবে তা হলো “অবশ্যই শেষ হবে” এই সত্য মেনে নিয়ে, নিজেকে অতিরিক্ত চাপ না দিয়ে, মনকে খানিকটা জায়গা রেখে কাজ করা।


উপসংহার──ডেডলাইনই এক ধরনের উদ্ধার

“কাজ ডেডলাইন এলেই শেষ হয়।”

এই বাক্য কাজের ভারে চূর্ণ হতে থাকা সবার জন্য একটি প্রেসক্রিপশন। সংক্ষেপে, “কাজ শেষ হবে; তাই মন ভেঙে যাওয়ার আগ পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।”

স্বস্তি নিয়ে কাজ করলে ফলাফলও মানসিক স্বাস্থ্যও স্থির থাকে, এবং ভালো সমাপ্তি সম্ভব হয়।

দগ্ধ প্রকল্পের মাঝে CTO-র ছুঁড়ে দেওয়া সেই কথাই এখনো আমার ভেতরের মূল ভরসা হয়ে আছে। দায়িত্ববোধ মহৎ হলেও, চাপে পড়ে স্বাস্থ্য বা জীবন নষ্ট হলে পারফরম্যান্সও আসে না, আর সবচেয়ে বড় কথা, তা দুর্ভাগ্যজনক।

আজ যদি কারও পাশেই অতিরিক্ত কাজের মৃত্যুর ছায়া ঘোরাফেরা করে, তবে এই কথাগুলো তার কাছে পৌঁছাক—এই কামনা।