ম্যানেজমেন্টে কোন যোগ্যতা দরকার?──সর্বশ্রেষ্ঠ না হয়েও দলকে এগিয়ে নেওয়ার শক্তি
ভূমিকা
বসের শর্ত নিয়ে কথা উঠলেই “নিজে উদাহরণ হও”, “নিজেই আগে এগোও” ইত্যাদি কথা শোনা যায়। কিন্তু বাস্তব জানলে বোঝা যায়, এ ধারণা অনেক সময় কাগুজে আদর্শ।
বস নিখুঁত নন। সেই অবস্থানে থাকা মানেই অতিমানব নন। কেবল একটি ভূমিকা পাওয়া। কখনো নিজের দেরির পরদিনই অধস্তনের দেরি নিয়ে নির্দেশ দিতে হয়। অথবা নিজের দক্ষতা কম হলেও কাজ ভাগ করে ফল চাইতে হয়।
এখানেই পাঠ্যবইয়ে কম আলোচিত আরেকটি “ম্যানেজমেন্ট যোগ্যতা” রয়েছে—নিজেকে সাময়িক পাশ কাটিয়ে বিষয় এগিয়ে নেওয়ার শক্তি।
“নিজেকে পাশ কাটানো” বলতে কী বোঝাচ্ছি
ভুল বুঝবেন না। এখানে “পাশ কাটানো” মানে দায়িত্ব ফেলে দেওয়া বা নির্লজ্জতা নয়। বরং “আমি নিখুঁত নই, তবু সংগঠনের জন্য দ্বন্দ্ব গিলে সামনে এগোই”—এই ক্ষমতা।
“আমি যা পারি শুধু সেটাই অধস্তনের কাছে চাইবো” ভাবলে কী হয়?
টিম বসের সামর্থ্যের সীমায় আটকে যায়। উন্নতি বা ফল কমে যায়। আর বস নিজেই চাপ সামলাতে গিয়ে ভেঙে পড়েন। ম্যানেজার নিখুঁত হওয়া পর্যন্ত সংগঠন অপেক্ষা করে না।
দ্বন্দ্ব গিলে ফেলার দায়িত্বই বসের কাজ
বসের কাজ “নির্ভুল উদাহরণ” দেখানো নয় (বরং অসম্ভব)। বরং দ্বন্দ্ব বুকে নিয়েও সংগঠনকে লক্ষ্যপানে চালিত করা।
-
দেরিতে আসার নির্দেশের দ্বন্দ্ব বস নিজে দেরি করলেও অধস্তনের দেরি ছেড়ে দিলে সংগঠনের শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। নিজেও ভুল করেন, তবু নিয়ম মানাতে হয়—এ কষ্ট সবচেয়ে বেশি বসেরই।
-
দক্ষতার অভাবের দ্বন্দ্ব আইটি-তে দুর্বল বসও নতুন সিস্টেম থামাতে পারেন না। নিজের অদক্ষতা বুঝেও “প্রয়োজন বলে” কাজ দেওয়ার দায় আছে। নিজেকে পাশ কাটিয়েও অধস্তনকে দায়িত্ব দিতে হয়; সেই অপরাধবোধ মুছে যায় না।
-
অনুভূতি নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্ব বসও মানুষ—অনুভূতির উত্থান থাকে। তবু অধস্তনের কাছ থেকে ঠান্ডা মাথার রিপোর্ট ও সিদ্ধান্ত চাইতে হয়।
দ্বন্দ্ব মুছে ফেলা অসম্ভব। বরং দ্বন্দ্বকে ধারণ করেও সংগঠনকে এগিয়ে নেওয়াই বসের নিয়তি।
নিজেকে পাশ কাটাতে না পারলে সংগঠন থেমে যায়
“আমি নিজেও পারি না, তাই অধস্তনকে বলব না”—এমন বস দেখতে ভদ্র লাগে। ব্যক্তি হিসেবে ঠিকও হতে পারে। কিন্তু সেই মনোভাব সংগঠনকে থামিয়ে দেয়।
- কেউ নিয়ম মানে না, ঢিলেমি দৈনন্দিন হয়ে যায়।
- নতুন চ্যালেঞ্জ বসের দক্ষতার সীমায় আটকে থাকে।
- অধস্তন ভুল বুঝে নেয়—“বসের সীমাই আমার সীমা।”
অর্থাৎ নিজেকে পাশ কাটাতে না পারা বস সংগঠনের সামগ্রিক উন্নয়নের সুযোগ কেড়ে নেন।
প্রকাশ্য আত্মতুষ্টি নেতৃত্ব হারায়
তবে সাবধান—এই ধারণাকে বস যদি ছাড়পত্র মনে করেন, মুহূর্তে পারফরম্যান্স ও নেতৃত্ব হারিয়ে ফেলবেন।
নিজে চেষ্টা না করে কেবল অধস্তনকে নির্দেশ দেন এমন বসকে কেউ বিশ্বাস করে না। কথার ওজন থাকে না, নির্দেশ ফাঁকা হয়ে যায়, নেতৃত্ব ভেঙে পড়ে। আগের যুগে ভয় দেখালে হয়তো চলত, এখন আর নয়—এমন করলে নিজের ক্যারিয়ারই শেষ হবে।
নিজেকে পাশ কাটিয়ে সংগঠন চালানো ও ঔদ্ধত্য—দুটি জিনিস আলাদা। এ দুয়ের ফারাক ব্যথা।
নিজেকে পাশ কাটাতে হয়—ম্যানেজমেন্ট, অর্থাৎ বস হওয়া এমনই যন্ত্রণার কাজ। সবসময় আত্মসমালোচনা ও অনুশীলন চালিয়েও, নিখুঁতভাবে মুছতে না পারা দ্বন্দ্বের ব্যথা বয়ে নিয়ে সংগঠনকে এগোতে হয়।
অহঙ্কারী ব্যক্তি ব্যথা অনুভব করেন না, অন্যকেই ব্যথা দেন।
বরং নিজেকে পাশ কাটালেও সেই ব্যথা অনুভব করে যাওয়া—এটিই ম্যানেজমেন্টে প্রয়োজনীয় অন্য এক যোগ্যতা।
প্রচলিত ম্যানেজমেন্ট যোগ্যতার সাথে তুলনা
সাধারণত “ভাল বসের গুণ” হিসেবে যা বলা হয়—
- যোগাযোগ দক্ষতা: অধস্তনের অবস্থা বুঝে সঠিকভাবে জানানো
- সিদ্ধান্ত গ্রহণ: সীমিত তথ্য বা সময়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া
- ন্যায় ও সততা: ধারাবাহিক নিয়মে মানুষকে আচরণ করা
- সমস্যা সমাধান: দ্বন্দ্ব বা সমস্যা গঠনমূলকভাবে সামলানো
- ভিশন ভাগ করা: দিকনির্দেশনা দেখিয়ে মানুষকে যুক্ত করা
Gallup-এর State of the American Manager (2015) বা “Why Great Managers Are So Rare” (2014) সহ বহু গবেষণা ও বইয়ে এই উপাদানগুলোকেই ভাল ম্যানেজমেন্টের অপরিহার্য গুণ বলে দেখানো হয়েছে।
কিন্তু বাস্তব ম্যানেজমেন্টে শুধু এগুলোতেই কাজ সারে না। যদি আপনি উপরের আদর্শের মত নিখুঁত হন, আলাদা কথা…
- ন্যায়কে চূড়ান্ত করলে, নিজে নিখুঁত না হওয়ায় অধস্তনকে নির্দেশ দিতে পারা যায় না—শৃঙ্খলা নরম হয়।
- নিখুঁত সিদ্ধান্ত চাইলে, নিজের দুর্বল ক্ষেত্র এগোয় না।
- সততা জোর দিলে “আমি পারি না তাই বলব না”—এমন অজুহাত হয়ে যায়।
অর্থাৎ, প্রচলিত ম্যানেজমেন্ট যোগ্যতা আসলে “আদর্শ ব্যক্তিত্ব”। কিন্তু বাস্তবে টিকে থাকতে চাইলে জ্ঞানগত দ্বন্দ্বে ঝাঁপিয়ে পড়ে, দ্বন্দ্ব নিয়ে এগোনোর “নিজেকে পাশ কাটানোর শক্তি”ও অপরিহার্য।
উপসংহার──নিখুঁত না হয়েও চালানোর শক্তি
প্রচলিত ধারণার পাশাপাশি, বাস্তবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ম্যানেজমেন্ট যোগ্যতা হলো “নিজেকে সাময়িক পাশ কাটিয়ে এগিয়ে নেওয়া”। বস দ্বন্দ্ব বয়ে নিয়ে, কখনো নিজের সীমা ছাড়াতে অধস্তনকে অনুরোধ করার ব্যথা অনুভব করেও সংগঠন এগিয়ে নিতে বাধ্য।
এটা নির্লিপ্ত ঔদ্ধত্য নয়; বরং সবসময় সেই দ্বন্দ্বের ব্যথা অনুভব করে যাওয়ার মাধ্যমেই তা ন্যায্যতা পায়।
নিখুঁত নই—তবু সংগঠন চালাই। এই দ্বন্দ্ব গিলতে পারা-না-পারা নির্ধারণ করে আপনি বস হিসেবে যোগ্য কিনা।
একসঙ্গে ভেবে দেখুন—
- নিজের দুর্বলতাকে অজুহাত বানিয়ে অধস্তনের চ্যালেঞ্জ থামাচ্ছি কি না?
- অধস্তনকে নির্দেশ দেওয়ার সময় নিজের দ্বন্দ্ব সচেতনভাবে উপলব্ধি করছি কি?
- যতটা পাশ কাটিয়েছি, ততটাই নিজেকে উন্নত করতে চেষ্টা করছি কি?
তথ্যসূত্র
-
Gallup, Inc. State of the American Manager: Analytics and Advice for Leaders. Gallup Press, 2015. 👉 https://www.gallup.com/services/182216/state-american-manager-report-2015.aspx
-
Gallup, Inc. “Why Great Managers Are So Rare.” Gallup Workplace, 2014. 👉 https://www.gallup.com/workplace/231593/why-great-managers-rare.aspx
-
Jack Zenger and Joseph Folkman. “The Skills Leaders Need at Every Level.” Harvard Business Review, July–August 2014. 👉 https://hbr.org/2014/07/the-skills-leaders-need-at-every-level
-
Marcus Buckingham. “What Great Managers Do.” Harvard Business Review, March 2005. 👉 https://hbr.org/2005/03/what-great-managers-do