ভূমিকা

পদোন্নতি—অসংখ্য কর্মীর কাছে ক্যারিয়ারের মাইলস্টোন এবং অনেক সময় পুরস্কারের মতো অনুভূত হয়। কাঁধে নতুন পদবি বসলেই নিজের মূল্য এক ধাপ বেড়ে গেছে বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক।

কিন্তু এখানে স্পষ্টভাবে বোঝা দরকার একটি সত্য। পদবি কোনো “মর্যাদা” নয়। তা কেবলমাত্র “যে সংগঠনে আছি সেখানে নির্দিষ্ট নির্দেশ ও সিদ্ধান্ত পালন করতে দেওয়া একটি ভূমিকা”, সর্বোচ্চ “বেতন বাড়ার একটি কারণ”। এর বেশি বা কম কিছুই নয়।


পদবি যে ভ্রান্তি এনে দেয়

পদবি পাওয়া মাত্রই দক্ষতা হঠাৎ বেড়ে যায় না। ব্যক্তিত্বও সম্পূর্ণ হয় না। সংগঠনের বাতাস বদলালেই মুহূর্তে বদলি হওয়া সম্ভব—একক মালিকানাধীন কোম্পানিতে মালিকের ইচ্ছে হলেই পদবি উধাও।

তবু প্রথম পদোন্নতির সময় “আমি বড় হয়ে গেছি” এমন ভ্রান্তিতে পড়া মানুষ কম নয়। যারা এই ফাঁদে পড়ে, তারা সাধারণত দুই পথে গড়ায়—

  • উর্ধ্বতনের প্রতি অতিরিক্ত তোষামোদ: পদ রক্ষায় মরিয়া হয়ে মতামত ও আচরণে কেবল মুখের হাসি, কোনো মূল্য নেই।
  • অধস্তনদের উপর অতিরিক্ত আধিপত্য: কর্তৃত্বকে অবস্থানের শ্রেষ্ঠত্ব ভেবে অহংকারী আচরণ শুরু হয়।

মনোবিজ্ঞানে জানা যায়—পদ ও ক্ষমতা হাতে এলে মানুষ অবচেতনে শ্রেষ্ঠত্ব অনুভব করে। বিখ্যাত স্ট্যানফোর্ড কারাগার পরীক্ষার চূড়ান্ত উদাহরণ দেখায়, ভূমিকাবান্ধব এই পরিবর্তন ব্যক্তিত্বকেও বদলে দিতে পারে। অর্থাৎ “ভ্রান্তি” শুধুই ব্যক্তিগত দুর্বলতা নয়; মানবজাতির সাধারণ প্রবণতা।

আরও আছে Self-esteem instability—তাৎক্ষণিক অভিজ্ঞতায় ওঠানামা করা আত্মমূল্যায়নের অনুভূতি। এক মুহূর্তের “পদোন্নতি”র মতো ঘটনাতেই আত্মবিশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে ফুলে ওঠে।

এসব কেবল সংগঠনের জন্য ক্ষতিকর নয়, বরং নিজের ভবিষ্যৎ ব্যক্তিত্বকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে


“তোষামোদের” ফাঁদ

পদবি পেলেই “অতিরিক্ত সম্মান দেখানো” মানুষের দেখা মিলবে। তুচ্ছ কথা বললেও সকলে মাথা ঝাঁকিয়ে প্রশংসা করে। কেউ কেউ সরাসরি চাটুকারিতা শুরু করে সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে।

মানুষ বলে কথা, আনন্দ লাগতেই পারে। কিন্তু এখানে যদি কঠোর আত্মশাসন না থাকে, ব্যক্তিত্ব গঠনের ফাঁদে পড়তে হয়। পদোন্নতি পাওয়া বসের সামনে সরাসরি সমস্যা তুলে ধরবে—এমন মানুষ খুব কম। কেউই আনন্দের সঙ্গে ক্ষমতার বিপরীতে দাঁড়াতে চায় না, বোকা বসকে খুশি করে সুবিধা নেওয়া সহজ।

এর পরিণামে পদধারী “নগ্ন রাজা” হয়ে যায়। ব্যবস্থাপক হিসেবে এখনও নবীন হলেও এমন মানুষ নিয়মিত দেখা যায়।


অভিজ্ঞতায় দেখা—নতুন ব্যবস্থাপকের ১–২ ভাগ ভুল পথে যায়

আমার অভিজ্ঞতায়—সংগঠনের মানবসম্পদ প্রক্রিয়া কতটা পরিপক্ব তার উপর নির্ভর করলেও—প্রথমবার ‘কাকারিচো’ (সেকশন ম্যানেজার) বা ‘কাচো’ (বিভাগপ্রধান) পদে ওঠা লোকদের প্রায় ১–২ ভাগ এই ফাঁদে পড়ে। কাজ পরিচালনা, হিসাব, আইন মেনে চলার মতো প্রয়োজনীয় জ্ঞান অপ্রতুল থাকে; দক্ষতাও বদলায় না অথচ আচরণ হঠাৎ উদ্ধত হয়ে ওঠে। এমন ব্যক্তি সুস্থ সংগঠনে দেরি না করে বাদ পড়ে।

আরও ভয়াবহ হল তাদের সামনে অপেক্ষা করা পরিণতি। পদবিকে “মর্যাদা” ধরে নেওয়ায়, পদ হারালেই গভীর আত্মবিরোধ ও দ্বন্দ্ব গ্রাস করে। ভূমিকা হারানোকে “নিজেকে অস্বীকার” হিসেবে ভুল বোঝে।


পদবিকে “ভূমিকা” হিসেবে দেখার দৃষ্টিভঙ্গি

যদি পদবিকে “ভূমিকা” হিসেবে বুঝি, অপসারিত হলেও কষ্ট কম হবে। “যতদিন প্রয়োজন ছিল, সেই ভূমিকা পালন করেছি। প্রয়োজন ফুরালে সরানো হয়েছে—এতেই শেষ” বলে ঠান্ডা মাথায় মেনে নেওয়া যায়। অধস্তনের প্রতি উচ্চাভিলাষী মনোভাবও জন্ম নেবে না।

উল্টোভাবে, পদবিকে “মর্যাদা” ভাবলে, হারানোর সঙ্গে জীবন অর্থও হারিয়ে গেছে বলে মনে হবে। ব্যক্তি নিজেই এতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত।


সারসংক্ষেপ—নিজেকে রক্ষা করার জন্যও

পদবি হলো ভূমিকা। মর্যাদা নয়। পদোন্নতি তাই কোনো গন্তব্য নয়, ব্যক্তিত্বের প্রমাণও নয়। সেরা মানুষরাই সবসময় পদোন্নতি পায় এমনও নয়; অধিকাংশ ক্ষেত্রে উর্ধ্বতনের সিদ্ধান্ত, ক্ষমতা, সঠিক সময় ও মূল্যায়নের মিলেই পদোন্নতি ঘটে।

অর্ধেকটাই ভাগ্য বললেও ভুল হবে না। এমন কিছুর মোহে পড়লে ব্যক্তিত্ব গঠনের পথ হারাবেন।

  • কর্তৃত্বের কাছে অনুগত হয়ে পড়বেন না।
  • অধস্তনকে হেয় করবেন না।
  • চাটুকার কথায় বিশ্বাস করবেন না।

এগুলো স্মরণে রাখলে “পদবি ব্যক্তিত্ব ধ্বংস করে” এমন ফাঁদ ও “পদ হারালে শূন্যতা”—উভয় থেকে নিজেকে রক্ষা করা যায়। অযোগ্যতার কারণে অপসারিত না হলেও অধিকাংশ মানুষ পদবি অবসরে বা প্রকৃত অবসরে পৌঁছে যায়। বুড়িয়ে গিয়ে ব্যক্তিত্ব নতুন করে গড়তে চাইলেও দেরি হয়ে যায়।

দীর্ঘায়ু সমাজে প্রয়োজনীয় মানসিক গঠনের অংশ হিসেবে এই নিবন্ধের মনোভাব গুরুত্বপূর্ণ।

পদোন্নতি নিয়ে গর্ব করা স্বাধীনতা। কিন্তু সত্যিই গর্বের বিষয় হল পদবির নয়, বরং ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখার দক্ষতা ও মনোভাব।