এআই কি তথ্যকে গণতান্ত্রিক করে, নাকি উন্মোচনের অস্ত্রে পরিণত করে?
ভূমিকা—এআই যে “লিংক” এনে দিল
একদিন অফিসে ব্যবহৃত এআই সহকারীকে আমি এক ভেন্ডর-প্রদত্ত টুল ব্যবহার করার উপায় জিজ্ঞেস করছিলাম। ওটা সুপরিচিত OSS বা সক্রিয় কমিউনিটি গড়ে ওঠা বাণিজ্যিক টুলের মতো নয়; ইন্টারনেটে সামান্যই তথ্য পাওয়া যায় এমন একটি টুল ছিল। এআই নিখুঁত সমাধান দিল, উপরন্তু “তথ্যসূত্র” বলে একটি লিংকও এগিয়ে দিল।
লিংকে ক্লিক করতেই পৃষ্ঠা স্বাভাবিকভাবে খুলে গেল। প্রয়োজনীয় তথ্য ঠিকই লেখা ছিল, কিন্তু শিরোনামে চোখে পড়ল—
“শাহগাই-হি, হি-কোকাই” লেখা ছিল (অর্থাৎ “কোম্পানির গোপন, বাহিরে নিষিদ্ধ”)।
আরে, এটা কোন প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ নথি? খুঁটিয়ে দেখে বুঝলাম, না আমাদের প্রতিষ্ঠানের, না ভেন্ডরের অফিসিয়াল নথি; বরং একই টুল ব্যবহার করা আরেক কোম্পানির অভ্যন্তরীণ ম্যানুয়াল।
ওয়াও, ভাগ্য খুলল নাকি?
…
না, বরং মুহূর্তেই মেরুদণ্ডে ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল।
এআই-কে উপেক্ষা করে মিলতি কীওয়ার্ডে সার্চ দিলে পৃষ্ঠাটি পাওয়া যেত ঠিকই, কিন্তু ফলাফলের ক’ডজন পৃষ্ঠা পরে। সাধারণভাবে খুঁজলে সেখানে পৌঁছানো প্রায় অসম্ভব।
প্রথম পর্ব: এআই যে “গণতন্ত্রীকরণ” আনে
রোবট-ভিত্তিক সার্চ ইঞ্জিন মানে বিশাল বালির পাহাড় থেকে মানুষের হাতে করে স্বর্ণকণা খোঁজা। প্রাসঙ্গিক পৃষ্ঠা উপরে আনতে সার্চ পরিষেবাগুলি আপ্রাণ চেষ্টা করে, কিন্তু সীমাবদ্ধতা আছে—বড় সাইটগুলো শীর্ষস্থান দখল করে রাখে, নিচে লুকোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য খুঁজে পাওয়া দুঃসাধ্য। প্রশ্নের সাথে মিলে গেলে এআই কিন্তু “স্বর্ণকণাই” হাতে তুলে দেয়, সেটা র্যাংকিংয়ের একেবারে তলায় থাকা সাইট থেকেও হোক না কেন।
- মানুষ যে তথ্য খুঁজতে কয়েক দশ মিনিট লাগাত, কিংবা হাল ছেড়ে দিত, প্রম্পট মিলে গেলে এআই তা মুহূর্তেই এগিয়ে দেয়।
- বিশেষজ্ঞ জ্ঞান বা নলেজ যাদের কাছে অধরা ছিল, তারাও এখন সহজে উত্তর ছুঁতে পারে।
এটা নিঃসন্দেহে তথ্য-অ্যাক্সেসের গণতন্ত্রীকরণ। ইন্টারনেট যেমন জ্ঞানের দখল বিশেষজ্ঞ আর অভিজাতের হাত থেকে সরিয়ে নিয়েছিল, এআই সেটাকে আরও বহুগুণ প্রসারিত করছে।
শিক্ষা ও গবেষণাতেও প্রভাব স্পষ্ট। আগে যেখানে বিশেষায়িত বই বা জার্নাল ঘাঁটা ছাড়া উপায় ছিল না, এখন ছাত্র বা পেশাজীবী হাতের মুঠোয় তা পেয়ে যাচ্ছে। স্টার্টআপরা বড় কনসালটিং চুক্তি ছাড়া কৌশল দাঁড় করাচ্ছে, ব্যক্তিরাও রাতারাতি অ্যাপ বানিয়ে ফেলছে।
প্রচার ক্ষেত্রেও একই কথা। ইন্টারনেট বিশ্বজুড়ে মতামত জানানোর সুযোগ দিলেও, অখ্যাত কারও কণ্ঠস্বর হঠাৎ নজরে পড়ার সম্ভাবনা কমই ছিল।
কিন্তু দেখুন না, এআই এমন এক পাতার তথ্য তুলে দিল, যার সার্চ র্যাংকিং ছিল ভয়াবহ নিচে। সম্ভবত ভুলবশত পাবলিক হয়ে থাকা, SEO কিছুমাত্র না করা, এমন এক ক্ষুদ্র পৃষ্ঠা—তবুও আমার প্রশ্নের নিখুঁত উত্তর সেখানেই মিলল। বলা চলে, তথ্য প্রচার আর অ্যাক্সেস—দু’দিক থেকেই—ইন্টারনেটের সক্ষমতাকে ছাড়িয়ে গিয়ে গণতন্ত্রীকরণ হলো।
দ্বিতীয় পর্ব: গণতন্ত্রীকরণের উল্টো পিঠ “উন্মোচন”
তবে এই গণতন্ত্রীকরণ যে একই সঙ্গে উন্মোচনও, সেটা এই অভিজ্ঞতাই আমাকে শেখাল।
সেই কোম্পানির তথ্য ভুল কনফিগারেশনের ফলে উন্মুক্ত ছিল। প্রচলিত সার্চ ইঞ্জিনেও তা সূচিবদ্ধ হয়েছিল, তাই তাত্ত্বিকভাবে তৃতীয় পক্ষের নজরে পড়ার সুযোগ ছিল। কিন্তু এআই না থাকলে হয়তো কেউই তা খুঁজে পেত না; সার্চ রেজাল্টের বিশ পৃষ্ঠা পর্যন্ত ধৈর্য ধরে পড়বে এমন মানুষ কমই আছে। “ভাগ্যিস কেউ দেখেনি” বলে বেঁচে যাওয়া তথ্য এআই-এর ক্ষমতায় চাহিদামতো মানুষের হাতে সেকেন্ডে পৌঁছে যায়। এই ঘটনার ক্ষেত্রে সেটা ছিল কেবল টুলের ব্যবহারবিধি (তাও গোপন রহস্য নয়), আর প্রশ্নও ছিল সদুদ্দেশ্যে, তাই ক্ষতি হয়নি…
কিন্তু যদি অনিচ্ছাকৃতভাবে উন্মুক্ত থাকা সংবেদনশীল তথ্য হতো, আর কেউ কু-উদ্দেশ্যে তা চাইত? “খুঁজে পাওয়া কঠিন” বা “মিলিয়ে দেখা দুরূহ”—এমন বাস্তবিক গোপনীয়তা যে ভেঙে পড়েছে, সেটাই অনুভব করলাম।
“গভীরে চাপা বলে নিরাপদ”—এআই যুগে আর খাটে না। একবার ইনডেক্সড হলেই, যে খুঁজছে তাকে দ্রুত পৌঁছে দেওয়া হয়।
ChatGPT-এর মতো বড় প্ল্যাটফর্মগুলো অবশ্য মন্দ উদ্দেশ্যে সাড়া না দেওয়ার নীতি ও ফিল্টার লাগায়, আর তা আরও শক্তিশালী হবে। কিন্তু ব্যক্তি যদি নীতিহীন নিজস্ব এআই তৈরি করে?
একসময় Winny নামের ফাইল-শেয়ারিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে “উন্মোচন ভাইরাস” জাপানে তোলপাড় করেছিল। আত্মরক্ষাবাহিনীর অভ্যন্তরীণ নথি থেকে কোম্পানির গ্রাহক তালিকা, ব্যক্তিগত ছবি-ভিডিও—সবই ফাঁস হয়ে বড় সামাজিক সমস্যা হয়। অনেক প্রতিষ্ঠান কর্মীদের কাছ থেকে Winny ব্যবহার না করার অঙ্গীকারপত্রও নিয়েছিল। ※ Winny নিজে কেবল পিয়ার-টু-পিয়ার ফাইল শেয়ারিং টুল; মূলত দাবি ছিল অযৌক্তিক, তবু তখনকার আবহে তা প্রায় প্রকাশ্যেই ঘটত।
কিন্তু জেনারেটিভ এআইয়ের সঠিক উত্তর দেওয়ার ক্ষমতা ভুল হাতে পড়লে সেই ঘটনার চেয়েও ভয়াবহ হতে পারে। একবার তথ্য লিক হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হলেই, অচিরেই তা কু-উদ্দেশ্যের মানুষের হাতে পৌঁছে যাবে। ভাইরাসও দরকার নেই—একটি ভুলই যথেষ্ট।
এআই প্রশ্ন পেলে বিনা দ্বিধায় “উত্তর” এগিয়ে দেয়; এর কোনো নৈতিকতা বা দায়বোধ নেই। ※ নীতিসম্পন্ন এআই হয়তো “দ্বিধা” করে, কিন্তু নীতিহীন এআই এখন ব্যক্তিগতভাবে বানানো সম্ভব—Hugging Face-এও এমন অনসেন্সরড মডেল মেলে।
এআই যুগে “গভীরে চাপা বলে নিরাপদ” বলে কিছু নেই।
উন্মোচন আবার একবারেই থেমে থাকে না। এআই শেখে, সারাংশ বানায়, অন্য ব্যবহারকারীদেরও তা দিয়ে সাহায্য করে—ফলে তথ্য একই সঙ্গে “ছড়ায় ও স্থায়ী হয়”。 কেউ খেয়াল করার আগেই, ফাঁস হওয়া তথ্য এআইয়ের মাধ্যমে প্রায় স্থায়ীভাবে ঘুরে বেড়াতে পারে।
তৃতীয় পর্ব: গতির অসমতা
আরেকটি গুরুতর সমস্যা হলো গতির অসমতা।
- এআই তথ্য সংগ্রহ করে, অনুকূল করে, চোখের পলকে পৌঁছে দেয়—বিশেষত চাহিদামতো হাতে পৌঁছানোর সক্ষমতা সার্চ ইঞ্জিনের তুলনায় বহুগুণ।
- আইন, নিয়ন্ত্রণ, নৈতিক কাঠামো, প্রতিকার বা ব্যক্তিগত সচেতনতা—মানবসমাজের এসব পরিবর্তন বছর ধরে হয়, তাত্ক্ষণিক নয়।
এই অসমতা ভয়কে আরও তীব্র করে।
গত তথ্যবিপ্লব—সংবাদপত্র, টিভি, সার্চ ইঞ্জিন—প্রতিটিতে কিছুটা করে ঘর্ষণ ও বিলম্ব ছিল; সমাজ সেই ফাঁকে নিয়ম বানানোর সময় পেত। এআই সেই ঘর্ষণ প্রায় শূন্যে নামিয়ে এনে, মুহূর্তে “সেরা উত্তর” বিশ্বজুড়ে পাঠিয়ে দেয়।
ফলে সঠিক জ্ঞান, ভুল গুজব, অস্বস্তিকর সত্য, ভুলের কারণে ফাঁস হওয়া তথ্য—এআই শিখেই ফেললে সবার কাছে একই গতিতে পৌঁছায়। বিশেষজ্ঞের গবেষণাপত্র আর বেনামে পোস্ট করা ভুল তথ্য, দুটিই এআই-এর মুখে সমান গুরুত্ব পেতে পারে—এই ভবিষ্যৎ ইতোমধ্যে শুরু।
চতুর্থ পর্ব: দায়বদ্ধতা কার?
এই ঘটনায় আমি লিংকটি খুলে ফেলেছিলাম। কিন্তু সেটা বেআইনি অ্যাক্সেস নয়—সার্চে পাওয়া যায়, কোনো প্রমাণীকরণ ভাঙিনি। সমস্যা হলো, “দেখা উচিত কি না” এই সিদ্ধান্ত পুরোপুরি মানুষের কাঁধে তুলে দেওয়া হয়েছিল, কিংবা “দেখানো উচিত কি না” তা নির্ধারণের কোনো পর্যায় ছিলই না।
এআই উত্তর দেয়, কিন্তু উত্তর দেওয়া উচিত কি না তা ভাবেও না। আগের নিবন্ধে আমি লিখেছিলাম—এআই-এর না আছে আত্মমর্যাদা, না বিশ্বাস, না দায়বোধ। তাই মানুষেরই সেই শূন্যস্থান পূরণ করতে হয়।
আমি সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ওয়েবসাইটের হোমপেজে গিয়ে যোগাযোগ ইমেইলে সতর্কবার্তা পাঠিয়েছিলাম। নিজেকে বাহবা দিতে চাই না, কিন্তু এআইয়ের দায়হীনতা মানুষিক দায়, বিবেক ও আশঙ্কা দিয়ে সামাল দিয়েছি।
অবশ্য সবাই এমন করবে, তা নিশ্চিত নয়—কেউ তথ্য ছড়িয়ে দিতে পারে, কেউ অজান্তেই অভ্যন্তরীণ তথ্য এআইকে শেখাতে পারে। আমার জানা পর্যন্ত এই বিষয়টি এখনও Winny-র ভাইরাস-ঘটনার মতো বড় সামাজিক সমস্যায় রূপ নেয়নি, কিন্তু অচিরেই তেমন ইস্যু মাথাচাড়া দেবে বলেই মনে হয়।
উপসংহার—এআই যুগের “দায়িত্ব নকশা”র দিকে
এআই তথ্য সংগ্রহে যেমন, প্রচারেও ইন্টারনেটের প্রথম যুগকে ছাড়িয়ে ভয়াবহ শক্তিতে গণতন্ত্রীকরণ ঘটায়। কিন্তু সেই শক্তির আড়ালে অনিচ্ছাকৃত উন্মোচন ঘটে, আর কু-উদ্দেশ্যের কারও হাতে তা “সঠিক ও দ্রুত” পৌঁছে যায়। ভয়ের মূলে আছে এই সত্য—আগে “ভুল করে প্রকাশ হয়েছিল, কিন্তু কেউ খুঁজে পায়নি বলে রক্ষা” সম্ভব ছিল; এখন “সেটিং ভুল হল আর ইনডেক্সড হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কু-উদ্দেশ্যের হাতে পৌঁছে গেল” বাস্তবতা।
কিংবা সেটিং ভুলও নয়—একসময় নির্দ্বিধায় প্রকাশ করা তথ্যগুলো যোগসূত্র দিয়ে দিলে অনায়াসে ব্যক্তির অজানা ছবি ভেসে ওঠে। আমি কৌতূহলবশত এই ব্লগের লেখা ChatGPT-কে পড়িয়েছিলাম; অনুভব অনুযায়ী প্রায় ৬০% সঠিকতায় আমার প্রোফাইল বানিয়ে ফেলেছিল। আমার কর্মস্থল বা নির্দিষ্ট বয়স ধরতে পারেনি (আনুমানিক বয়স ঠিকই বলেছে), ভুলও করেছে—তবু আশঙ্কাজনকভাবে কাছাকাছি ছিল। ※ স্টাইলোমেট্রি গবেষণায় দেখা গেছে, কয়েক ডজন লাইনের টেক্সট থেকেও লেখক শনাক্ত করা যায়।
বিষয়ের ওপর নির্ভর করে কখনো পুরোপুরিই ধরতে পারে। আপাতদৃষ্টিতে ক্ষতিকর নয় এমন তথ্য একসাথে গেঁথে নিলে বিস্ময়কর বাস্তব প্রকাশ পেতে পারে। ※ OSINT (Open Source Intelligence) অর্থাৎ উন্মুক্ত তথ্যভিত্তিক অনুসন্ধান ও বিশ্লেষণ—এআই তা আরও শক্তিশালী ও সহজ করেছে; যে কেউ, যেকোনো লক্ষ্যকে, উদাহরণস্বরূপ অনুসরণকারীও, এভাবে বিশ্লেষণ করতে পারে।
এখনকার চ্যালেঞ্জ কেবল নিরাপত্তা জোরদার নয়। এআই যুগের উপযোগী দায়িত্ব ও নিরাপত্তা নকশা—তথ্য গণতন্ত্রীকরণের গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সমাজের নিয়ম-কানুন ও প্রতিকার ভাবতে হবে।
এআই জ্ঞানের দূরত্ব আগে কখনও না দেখা মাত্রায় কমিয়ে দিয়েছে। একই সঙ্গে “কেউ খুঁজে পাবে না” এই নিরাপত্তার মিথ ভেঙে পড়েছে। সমাধান আজই মাথায় না এলেও, এআই যখন তথ্যের সীমানা গলিয়ে দিয়েছে, আমাদের তথ্য ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি প্রয়োজন—এটা নিশ্চিত।
এখন থেকে প্রত্যেকেরই গণতন্ত্রীকরণ আর উন্মোচনের দুই পিঠ নিয়ে বাঁচতে হবে।