ম্যানেজমেন্ট কী?──সংজ্ঞাহীন ব্যবস্থাপকরা কেন ব্যর্থ হন
ভূমিকা──দীর্ঘদিনের অস্পষ্ট শব্দ
“ম্যানেজমেন্ট” শব্দটির মতো এমন শব্দ খুব কম আছে, যা মাঠের কাজে ও কর্পোরেট ব্যবস্থাপনার স্তরে এত ঘন ঘন ব্যবহার হলেও যার প্রকৃত অর্থ অস্পষ্টই থেকে যায়। ব্যবস্থাপকের পদে থেকেও যখন অধীনস্থ বা জুনিয়র কেউ জিজ্ঞেস করে “ম্যানেজমেন্ট বলতে কী বোঝায়?”, তখন স্পষ্ট ও সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেন না এমন মানুষও কম নন। তবু “আমি জানি না” বলাটাও সম্ভব হয় না বলে, প্রশ্নের মুখে পড়লে কেউ কেউ কোনোমতে কিছু যুক্তিযুক্ত শোনানো প্রশ্ন উল্টো ছুড়ে দেন, “তুমিই ভেবে দেখো” বলে শিক্ষার ভান করেন এবং বাস্তবে পালিয়ে যান—এমন দৃশ্য আমি বহুবার দেখেছি।
নিজস্ব সুস্পষ্ট সংজ্ঞা না থাকলে ম্যানেজমেন্ট করা অসম্ভব। যে কাজের অর্থই বোঝা হয়নি, সেটি সম্পাদন করাও যায় না।
লিডারশিপে জন্মগত গুণ বা ক্যারিশমা ভূমিকা রাখতে পারে, কিন্তু ম্যানেজমেন্ট নিখাদ কার্যকলাপ। কার্যকলাপ হওয়ায় সংজ্ঞাহীন অবস্থায় তা বাস্তবায়ন করা যায় না।
ম্যানেজমেন্টের সংজ্ঞা──উদ্দেশ্য পূরণের সব কার্যকলাপ
আমার অবস্থান স্পষ্ট। ম্যানেজমেন্ট এক কথায় বললে “উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় সব কার্যকলাপ”।
এই সংজ্ঞাটিকে আরও স্পষ্ট করতে গেলে দেখা যায়, ম্যানেজমেন্ট তিনটি স্তরের কাজ নিয়ে গঠিত।
- উপাদানের সমন্বয়: প্রক্রিয়া, নিয়ম ও প্রণালী নকশা করে উদ্দেশ্য পূরণে সহায়ক করে তোলা। → উদাহরণস্বরূপ, নিয়ম নির্ধারণ করা, রিপোর্টের ধরন ঠিক করা, অগ্রগতি নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা বানানো এবং লক্ষ্য পূরণের জন্য কোন কোন কার্যকলাপ হবে তা নকশা ও বাস্তবায়ন করা।
- সম্পদের সমন্বয়: মানুষ, উপকরণ, অর্থ, সময়—এই সম্পদগুলোকে প্রয়োজনীয় মাত্রা ও গুণমানে নিশ্চিত করা। → উদাহরণ হিসেবে সম্পদ সংগ্রহ করা, মানুষকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করা, দায়িত্ব বদল করা, নির্দিষ্ট উপাদানের দায়িত্ব দেওয়া বা প্রয়োজনে সম্পদ কমিয়ে আনা।
- পরিবেশের সাথে সমন্বয় ও অভিযোজন: বাহ্যিক পরিবেশ, বাজারের পরিবর্তন, হুমকি ও সীমাবদ্ধতার সাথে খাপ খাইয়ে স্থায়ীভাবে লক্ষ্য অর্জনের উপযোগী অবস্থা বজায় রাখা। → উদাহরণস্বরূপ বাহ্যিক সংস্থার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা, সামাজিক দায়িত্ব পালনের ব্যবস্থা, বহিরাগত ঝুঁকি মোকাবিলা, বিধিনিষেধের প্রতি সাড়া দেওয়া, কিংবা প্রয়োজন হলে লক্ষ্যমান সামঞ্জস্য করা।
সারকথা, যে সংগঠন আপনার তত্ত্বাবধানে আছে তাকে একটি সিস্টেম ধরে নিয়ে, তার অস্তিত্বের উদ্দেশ্য বজায় রাখতে উপাদান ও সম্পদকে পরিবেশের ভেতর সমন্বিত রাখা—আমার কাছে সেটাই ম্যানেজমেন্ট।
এই নিবন্ধে আমি নিজের মত তুলে ধরেছি বটে, তবু নিশ্চিন্ত থাকুন। ড্রাকারও বলেছেন, “ম্যানেজমেন্ট হলো কাজ, এবং শৃঙ্খলাবদ্ধ বাস্তব অনুশীলন।”
ফলত আপনি যে সংগঠন পরিচালনা করেন তার সব কিছুই ম্যানেজমেন্টের ওপর নির্ভরশীল। কয়েক দশক আগে আমি যে ম্যানেজারের অধীনে অসন্তুষ্ট ছিলাম (নিজের মনেই তাঁকে অযোগ্য বলে ধরে), তখন থেকেই এই সত্য বদলায়নি; Gallup-এর State of the Global Workplace 2025 রিপোর্টও জানায়, দলের এনগেজমেন্ট কমার সবচেয়ে বড় কারণ হলো ম্যানেজারের এনগেজমেন্ট কমে যাওয়া। এটি সার্বজনীন বাস্তবতা।
লিডারশিপের সঙ্গে পার্থক্য──গন্তব্য আঁকার ক্ষমতা
তাহলে বারবার আলোচিত লিডারশিপ ও ম্যানেজমেন্টের পার্থক্য কী?
- লিডারশিপ মানে সংগঠনের অস্তিত্বের কারণ ধরে “আমরা কোথায় যাচ্ছি” তা নির্ধারণ করা এবং দলকে ফলাফলের দিকে নিয়ে যাওয়া। কোম্পানির দর্শন বা নীতি সেই দিশাকে সুনির্দিষ্ট করে।
- ম্যানেজমেন্ট মানে নির্ধারিত গন্তব্যে পৌঁছাতে উপাদান, সম্পদ ও পরিবেশ সাজিয়ে অবিরত এগিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা।
মানচিত্রে সবাইকে টানার মতো গন্তব্য আঁকা লিডারশিপের কাজ; সেখানে পৌঁছাতে জাহাজ চালিয়ে যাওয়া ম্যানেজমেন্ট। দুটো একে অন্যকে পরিপূরক হলেও তাদের ভূমিকা স্পষ্টভাবে ভিন্ন।
লাভ ও পরিবেশ──CSR/ESG-এর অবস্থান
পুঁজিবাদী সমাজে লাভজনক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের কারণ হলো “অবিরত লাভ করা।” এটি স্বতঃসিদ্ধ।
অন্যদিকে সাম্প্রতিক সময়ে CSR ও ESG-এর মতো সামাজিক চাহিদা গুরুত্ব পেয়েছে। এখানে ভুল বোঝা চলবে না—এসব কোনো নতুন লক্ষ্য নয়।
প্রতিষ্ঠানও পরিবেশের মধ্যে থাকা একটি সিস্টেম। CSR/ESG উপেক্ষা করলে সামাজিক আস্থা হারাবে, বিধিনিষেধ ও সমালোচনার মুখে পড়বে, ফলত ধারাবাহিকভাবে লাভ করা অসম্ভব হবে। তাই ESG ও CSR পরিবেশগত উপাদান হিসেবে ম্যানেজমেন্টের আওতায় পড়ে। লাভের লক্ষ্য ধরে রাখতে পরিবেশে অভিযোজন অপরিহার্য। অতএব “ESG বা CSR এসেছে বলে ম্যানেজমেন্টের সংজ্ঞা বদলে গেছে” কিংবা “নতুন যুগের ম্যানেজমেন্ট” ইত্যাদি দাবি নিছক হালকা কথাবার্তা।
Gallup-এর রিপোর্টও দেখায়, ম্যানেজাররা “গ্রাহকের নতুন প্রত্যাশা”, “AI ও ডিজিটাল রূপান্তর”, “নমনীয় কাজের ধরন”সহ নানা বাহ্যিক চাপের মুখে থাকেন। CSR/ESG-সহ এই পরিবেশগত উপাদানগুলিই ম্যানেজমেন্টের কাজের অংশ; হঠাৎ করে ম্যানেজমেন্টের সংজ্ঞা বদলে গেছে—এমনটি নয়।
‘সংজ্ঞাহীন’ ব্যবস্থাপক কেন ব্যর্থ হন
তাহলে ব্যর্থ ম্যানেজমেন্টের আদর্শ ছবি কী?
সেটা হলো, স্পষ্ট সংজ্ঞা ছাড়াই ব্যবস্থাপক হয়ে বসা মানুষ।
কখনও কখনও সাময়িক ফল পাওয়া যায়। কাকতালীয়ভাবে দক্ষ কর্মী পাওয়া যায়, বা অনুকূল পরিবেশ সাহায্য করে। কিন্তু তা স্থায়ী হয় না। পরিবেশ বদলালে কাঠামো ভেঙে পড়ে, অধীনস্থরা চলে গেলে পুরো ব্যবস্থাই গুঁড়িয়ে যায়।
সংজ্ঞাহীন ব্যবস্থাপকের ব্যর্থতা কাকতালীয় নয়। কারণ তারা ম্যানেজমেন্টকে কার্যকলাপ হিসেবে ধরতেই পারেননি।
সাফল্যের কঠিনতা──প্রয়োজনীয় শর্ত ও পর্যাপ্ত শর্ত
আবার প্রশ্ন আসে, ম্যানেজমেন্টের সংজ্ঞা দিতে পারলেই কি সফলতা নিশ্চিত? না।
সংজ্ঞা বোঝা ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজনীয় শর্ত, কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়।
সম্পদের ঘাটতি, বহির্পরিবেশের আকস্মিক পালাবদল, ক্ষমতার বাইরে রাজনৈতিক চাপ—এমন পরিস্থিতি আছে যেখানে শ্রেষ্ঠ ম্যানেজারও লক্ষ্য ছুঁতে পারেন না। ম্যানেজমেন্ট যেহেতু কার্যকলাপ, তাই এটি চালিয়ে যেতে হয়। তবু এমন শর্ত আসতে পারে যেখানে লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। এই পার্থক্য না বুঝে “ম্যানেজমেন্ট সর্বক্ষমতা” ভাবলে, উল্টে প্রতিষ্ঠানই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
Gallup-এর রিপোর্টও এটিই জোর দেয়। মৌলিক প্রশিক্ষণ পাওয়া ম্যানেজারদের মধ্যে “সক্রিয় অসন্তোষ” অনুভব করার হার প্রশিক্ষণ না পাওয়া ব্যক্তির তুলনায় অর্ধেক। কোচিং কৌশল শিখলে তাদের কর্মদক্ষতা ২০–২৮% বাড়ে, আর ধারাবাহিক ট্রেনিং ও উন্নয়ন সহায়তা পেলে ব্যবস্থাপকের নিজের সুখের মাত্রা ৩২% উন্নত হয়। অর্থাৎ “সংজ্ঞা”, “স্কিল উন্নয়ন” ও “পরিবেশ অভিযোজন”—এই তিনটি একসঙ্গে এলেই প্রতিষ্ঠান টেকসই সাফল্যের কাছাকাছি পৌঁছায়।
ম্যানেজমেন্ট মানে ফলাফলের দায়
শেষ পর্যন্ত ম্যানেজমেন্ট ও লিডারশিপ মূল্যায়নের সূচক খুব সরল—ফলাফলের দায়।
লাভজনক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্বের কারণ হলো ধারাবাহিকভাবে লাভ করা। সেই লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে কিনা, সেটাই ভালো ম্যানেজমেন্টের একমাত্র মানদণ্ড। প্রক্রিয়া বা পদ্ধতি কেবল সহায়ক রেখা; চূড়ান্তভাবে সবকিছু নির্ধারিত হয় “উদ্দেশ্য পূরণ হয়েছে কি হয়নি” দ্বারা।
উপসংহার──সংজ্ঞা ধরুন এবং কার্যকলাপ থামাবেন না
ম্যানেজমেন্ট কী? উত্তর সহজ। ম্যানেজমেন্ট মানে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পূরণ—অর্থাৎ ধারাবাহিকভাবে ফলাফল এনে দিতে যে সমস্ত কার্যকলাপ প্রয়োজন, তার সমষ্টি।
- নিজস্ব সংজ্ঞা ছাড়া ম্যানেজমেন্ট করা যায় না।
- ধারাবাহিক ফলাফল আনলেই “দক্ষ” বলে মূল্যায়িত হওয়া যায়।
- পরিবেশ উপাদানগুলো লক্ষ্য নয়, বরং সীমাবদ্ধতা।
- “ম্যানেজমেন্ট সব পারে” ধারণা ভুল, কিন্তু কার্যকলাপ চালিয়ে গেলে “ম্যানেজমেন্ট করা যায় না” এমন অবস্থা বলে কিছু নেই।
ম্যানেজমেন্ট কোনো জাদু বা জন্মগত প্রতিভা নয়। সংগঠনকে সিস্টেম হিসেবে দেখে, পরিবেশে অভিযোজিত হয়ে উদ্দেশ্য পূরণের জন্য অবিরাম পরিশ্রম করা। পদ্ধতিগত নির্দেশনা হয়তো নেই, কিন্তু নানা পন্থা বিদ্যমান। সেই সত্তা না ভুললে, ‘সংজ্ঞাহীন ব্যবস্থাপক’-এর মতো কাকতালীয় বা অধীনস্থনির্ভর ঝুঁকি থেকে সংগঠনকে একধাপ মুক্ত করা সম্ভব।
FAQ (প্রায় জিজ্ঞেস করা প্রশ্ন)
Q: ম্যানেজমেন্ট বলতে কী বোঝায়? A: সংগঠন বা দলের লক্ষ্য পূরণে মানুষ, সম্পদ, তথ্য ও প্রক্রিয়াকে পরিকল্পনা, সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণ করার সব কার্যকলাপকেই বোঝানো হয়। এটি কেবল পদবীর ব্যাপার নয়; বরং “ধারাবাহিকভাবে ফলাফল এনে দেয় এমন ব্যবস্থা ধরে রাখা”।
Q: ম্যানেজমেন্ট ও লিডারশিপের পার্থক্য কী? A: লিডারশিপ হলো “সবার কাছে গ্রহণযোগ্য গন্তব্য নির্ধারণ করা”, আর ম্যানেজমেন্ট হলো সেই গন্তব্যের দিকে এগোতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা ও সম্পদ সমন্বয় করা এবং পরিবেশের সাথে মোকাবিলা করা। দক্ষ ব্যবস্থাপক দুটোই করেন, কিন্তু একটিমাত্র থাকলে দীর্ঘমেয়াদী ফল আসে না।
Q: শুধু পদবি থাকা ব্যবস্থাপক কেন ব্যর্থ হন? A: কারণ তারা ম্যানেজমেন্টের সংজ্ঞা বোঝেন না এবং তা কেবল লোকজনকে তাৎক্ষণিক নির্দেশ দেওয়ায় সীমাবদ্ধ রাখেন। ফলে একবার কোনো ফল এলেও পুনরাবৃত্তি হয় না, দক্ষ কর্মীরা সরে গেলে তাৎক্ষণিকভাবে ধস নেমে আসে।
Q: ম্যানেজমেন্ট শূন্য থাকা সংগঠনের লক্ষণ কী? A: “কোনো একজন বিশেষ দক্ষ মানুষ থাকলেই ফল আসে”, “একটি সাফল্যের পর দীর্ঘ ব্যর্থতা”, “অধীনস্থরা ক্লান্ত হয়ে চাকরি ছাড়ে”—এসবই সাধারণ লক্ষণ।
তথ্যসূত্র ও সম্পর্কিত লিংক
- পিটার এফ. ড্রাকার, Management: Kihon to Gensoku (ডায়মন্ড শা)।
- Gallup, State of the Global Workplace, 2025.