জেনারেটিভ AI-তে প্রাণঘাতীভাবে অনুপস্থিত কী: আত্মমর্যাদা, বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ এবং ‘আমি’
ভূমিকা
গভীর রাতে, ওয়াক-ইন ক্লোজেট থেকে রূপান্তরিত এক স্টাডি রুমে আমি নিরন্তর এক জেনারেটিভ AI-র সাথে কথোপকথন করছিলাম। বন ওবোনের ছুটির মাঝামাঝি, তবুও ঘুমের ঘাটতি মেনে ChatGPT-কে প্রশ্ন ছুড়ছিলাম, উত্তরে কখনও মুগ্ধ হচ্ছিলাম, কখনও বিরক্ত হচ্ছিলাম।
নোট যারা জাপানের ওবোন উৎসবের সঙ্গে পরিচিত নন তাদের জন্য: ওবোন মধ্য আগস্টে পালিত একটি বৌদ্ধ স্মরণ-উৎসব, যেখানে পরিবারগুলো পূর্বপুরুষদের শ্রদ্ধা জানাতে নিজ নিজ শহরে ফিরে যায়; সেই সময় অনেক প্রতিষ্ঠান ছুটি দেয় বা কাজের সময় কমিয়ে আনে।
এমন সময়ের পুনরাবৃত্তির পর হঠাৎ স্পষ্ট হয়ে উঠল একটি সত্য।
—জেনারেটিভ AI-র ভিতরে প্রাণঘাতী এক শূন্যতা রয়েছে।
তা হলো আত্মমর্যাদা, বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ।
খালি “মনোশক্তি নির্ভর তত্ত্ব” (জাপানি আলোচনায় যাকে ‘কনজো রন’ বলা হয়) বা “শুধু আত্মিক উৎসাহের বক্তৃতা” (যাকে ‘সেইশিন রন’ বলা হয়) পছন্দ করি না, তাই সাধারণত এমন শব্দ ব্যবহার করি না। কিন্তু যতই অন্য ভাষা খুঁজে দেখি, শেষ পর্যন্ত এই শব্দগুলিতেই ফিরে আসতে হয়।
আর এভাবেই বুঝতে পারলাম—আমি হয়তো সেই কেন্দ্রবিন্দু স্পর্শ করেছি, যে কারণে জেনারেটিভ AI কখনও পুরোপুরি মানুষের বিকল্প হতে পারে না।
পেশাদারের কাছ থেকে আমাদের প্রত্যাশা
যেকোনো পেশাজীবীর কাছেই আমরা শুধু জ্ঞান বা দক্ষতা নয়, নৈতিক অবস্থানও প্রত্যাশা করি।
ধরা যাক, একটি এয়ারকন্ডিশনিং কোম্পানির কর্মী গ্রাহকের নির্দেশে দেয়ালে ছিদ্র করতে গিয়ে ভেতরে একটি প্রধান বিম দেখতে পেলেন। তখন কি বলা যায়, “গ্রাহক বলেছিলেন, তাই আমার কোনো দায় নেই”? আইনগত ব্যাখ্যা যাই থাকুক, নৈতিক দায়িত্ব নিশ্চিতভাবেই থাকবে। গ্রাহকও আসলে চান না কেউ অন্ধভাবে নির্দেশ মেনে চলুক; ঝুঁকি বোঝানো ও ভালো বিকল্প দেওয়া—এসবকেই তারা “স্বাভাবিক” বলে ধরে নেন।
এই আত্মমর্যাদা, বিশ্বাস এবং দায়িত্ববোধই পেশাদারিত্বের আসল যোগ্যতা।
আজকের জেনারেটিভ AI ও তার সীমা
জেনারেটিভ AI জ্ঞান আর ভাষা চমৎকারভাবে অনুকরণ করতে পারে। কিন্তু “আত্মমর্যাদার পরিপন্থী বলে কাজ ফিরিয়ে দেওয়া” বা “সামনের ব্যক্তির নিরাপত্তার দায় নিজের কাঁধে নেওয়া”র মতো মনোভাব গ্রহণ করতে পারে না।
বর্তমানে সেই শূন্যতা ভরাট করার কাজ করে সার্ভিস প্রদানকারীর নীতি।
অ্যান্টি-সোশ্যাল ব্যবহার বা অ্যাডাল্ট কনটেন্ট নিষিদ্ধ করার মতো স্পষ্ট সীমারেখা আঁকা যায়। কিন্তু “পেশাদার হিসেবে কি আরও ভালো প্রস্তাব দেওয়া উচিত?”—এ ধরনের গ্রে-জোনের সিদ্ধান্তে তারা দুর্বল।
ব্যবহারকারী যদি খুঁটিয়ে প্রম্পট লেখে, কিছুটা ঘাটতি পুষিয়ে নেওয়া যায়। তবু সেই AI অনেকটা এমন রাঁধুনির মতো, যিনি রেসিপি নিখুঁতভাবে অনুসরণ করেন কিন্তু কখনও স্বাদ চেখে দেখেন না। রেসিপিতে লেখা নেই এমন পূর্বশর্ত বা বাহ্যিক পরিবর্তন থাকলে, সেই খাবার ভীষণ অরুচিকর হয়ে যেতে পারে—আর সে নির্বিকার মুখে তা পরিবেশন করে। লজ্জা পায় না, নতুন করে বানাতেও হুড়োহুড়ি করে না।
কেন এখনো মানুষের প্রয়োজন (কমপক্ষে এখন)
এই কারণেই বর্তমান বাস্তবতায় মানুষকে দায়িত্বশীল সমন্বয়কারীর ভূমিকায় রেখে AI ব্যবহার করতে হয়।
নীতি-নৈতিকতা, আইনব্যবস্থা, ডেভেলপমেন্ট গাইডলাইন, এমনকি ব্যবহারকারীর শিক্ষাও “AI মানুষকে সাহায্য করার একটি হাতিয়ার মাত্র” ধরে নিয়ে তৈরি হয়েছে।
তবে এ সবই “এখনকার” ছবি। ভবিষ্যতে AI দায়িত্বের অনুকরণ শিখে ফেলবে—এই সম্ভাবনা পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিশ্বজুড়ে গবেষণা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষা
AI-কে “দায়িত্ববান” মনে হওয়ার মতো আচরণ শেখাতে গবেষণা ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে।
- বর্ণনামূলক নীতি (Delphi): কী ভালো আর কী মন্দ—AI-কে শেখানোর উদ্যোগ। কিন্তু ধারাবাহিকতা ও পক্ষপাত এখনো বড় বাধা।
- Meaningful Human Control: AI পুরোপুরি স্বয়ংক্রিয়ভাবে সিদ্ধান্ত না নিয়ে, মানুষের চূড়ান্ত নিয়ন্ত্রণে থাকার নকশা নীতি; স্বয়ংচালিত গাড়ি ও সামরিক খাতে এই নিয়ে আলোচনা চলছে।
- মূল্যবোধ শেখা (Value Learning): মানুষের আচরণ ও প্রতিক্রিয়া থেকে মূল্যবোধ আন্দাজ করে নৈতিক বিচ্যুতি কমানোর চেষ্টা।
- NIST AI RMF-এর মতো ফ্রেমওয়ার্ক: দায়িত্বশীল AI তৈরির জন্য বিস্তৃত প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো।
এগুলো এখনো অঙ্কুর মাত্র, কিন্তু ভবিষ্যতে AI-কে “দায়িত্ব পালন করছে” বলে দেখানোর বুনিয়াদ হয়ে উঠতে পারে।
দায়িত্ব অনুকরণ মানে কী?
একটু থেমে ভাবা দরকার—“দায়িত্ব অনুকরণ” বলতে আসলে কী বোঝায়?
দায়িত্বের অন্তত দুইটি স্তর রয়েছে।
- ফলাফলের দায়: কাজের ফল নিজের কাঁধে নেওয়া।
- উত্তরের দায়: অন্যের প্রশ্ন বা প্রত্যাশার সামনে ব্যাখ্যা দিয়ে সাড়া দেওয়া।
AI সর্বোচ্চ যা করতে পারে, তা হলো ঝুঁকি শনাক্ত করে সতর্ক করা, বা সিদ্ধান্তের ভিত্তি স্বচ্ছ করা।
অর্থাৎ AI-র দায়িত্ববোধ “স্বচ্ছতা ও আত্মসংযম” আকারে সিমুলেট হয়।
তবু এ কথাও সত্য, মানব বুদ্ধিমত্তা ও আমাদের দায়িত্ববোধও হয়তো মস্তিষ্কের সিমুলেশন ছাড়া কিছু নয়।
তবুও বর্তমান AI এবং কিছু মানুষের আত্মমর্যাদা, বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ—এই দুইয়ের মধ্যে আমি প্রকট ফারাক অনুভব করি। ফারাকটি কোথা থেকে আসে?
মানুষ ও AI-এর ব্যবধান তৈরি করে কী
আমার মনে হয় তিনটি কারণ মূলত এই ব্যবধান সৃষ্টি করে।
- শরীরী ও সামাজিক ব্যথা
মানুষ ভুল করলে শারীরিক, অর্থনৈতিক বা সামাজিক ব্যথা পায়। এই ব্যথাই দায়িত্বকে “বাস্তব” অনুভব করায়। AI ব্যর্থতার রেকর্ড রাখতে পারে, কিন্তু তা তাকে ব্যথা হিসেবে ফিরিয়ে দিতে পারে না। - সময়ের ওপারে ধারাবাহিকতা
মানুষকে নিজের কাজের ফল দীর্ঘ সময় ধরে বয়ে বেড়াতে হয়। এক ডাক্তারের ভুল নির্ণয় বছরের পর বছর পর বিচার হতে পারে। AI চাইলে পরক্ষণেই উল্টো কথা বলতে পারে, কোনো ওজন কাঁধে না নিয়েই। - মূল্যবোধ ও পরিচয়
মানুষ বলতে পারে, “এটা আমার বিশ্বাস, আমি আপস করব না।” এটা সমাজ ও সংস্কৃতির সঙ্গে জুড়ে থেকে পরিচয় তৈরি করে। AI-এর নিজস্ব পরিচয় নেই; মুহূর্তে অবস্থান বদলে নিতে পারে।
এইভাবে বেশিরভাগ মানুষের দায়িত্ববোধ ব্যথা, ধারাবাহিকতা ও মূল্যবোধের সঙ্গে মিশে ঘন হয়ে ওঠে। একইসঙ্গে এমন মানুষও আছে যারা দায়িত্বজ্ঞানহীন বা নীতিহীন আচরণ করে।
অর্থাৎ এই ব্যবধান হয়তো মানুষের “স্বভাবগত সারাংশ” বনাম AI-এর পার্থক্য নয়, বরং দায়িত্বকে সমর্থন করার মতো সামাজিক অভিজ্ঞতা ও অন্তর্ভুক্তির কাঠামো আছে কি না—সেই প্রশ্ন।
‘আমি’ ও দায়িত্ব
এখানে ডেকার্তের “আমি চিন্তা করি, তাই আমি আছি” মনে পড়ে।
দায়িত্ববোধ শুধু নিয়ম মানা নয়; তা “আমি”-র অভ্যন্তরীণ অভিজ্ঞতার ওপর দাঁড়ায়। ব্যথা, অনুশোচনা, সংশয়, অস্থিরতা—এসব ব্যক্তিগত অনুভূতি “আমি দায় নিচ্ছি” বলে বিশ্বাস করার শক্তি তৈরি করে।
বর্তমান AI-র কোনো “আমি” নেই। ইনপুট ও আউটপুট জোড়া লাগানো প্রসেস আছে ঠিকই, কিন্তু ব্যথা নিজের ওপর ফিরে আসার ব্যবস্থা নেই, লজ্জা বা আত্মমর্যাদা অনুভব করারও উপায় নেই। তাই আমরা সেখানে দায়িত্ববোধ দেখতে পাই না; বরং অনেক সময় দায়িত্বজ্ঞানহীন কোনো মানুষ যেমন নির্বিকার উত্তর দেয়, AI-ও তেমনই স্বাচ্ছন্দ্যে আউটপুট দেয়।
সম্ভবত মানুষের দায়িত্ববোধও মস্তিষ্কের সিমুলেশনের ফল মাত্র। তবু দক্ষ মানুষের সিমুলেশন যা তৈরি করে, বর্তমান AI এখনো সেখানে পৌঁছায়নি। আসল প্রশ্ন হলো—AI-র অনুকৃত দায়িত্ববোধ সামাজিকভাবে কাজ করে কি না।
সারসংক্ষেপ ও প্রশ্ন
- জেনারেটিভ AI-তে আত্মমর্যাদা, বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ অনুপস্থিত।
- বর্তমানে মানুষকে দায়িত্বশীল সমন্বয়কারী হিসেবে রেখে সেই ঘাটতি পূরণ করতে হয়।
- “দায়িত্ব অনুকরণ” নিয়ে বিশ্বজুড়ে গবেষণা চলছে, কিন্তু “আমি” না থাকলে AI দক্ষ মানুষের মান থেকে এখনো অনেক দূরে।
- এমনকি মানুষের দায়িত্ববোধও সিমুলেশন হতে পারে।
শেষ পর্যন্ত প্রশ্নটি খুব সরল।
AI-কে কি “ব্যথা” অনুভব করানো সম্ভব?
সম্ভবত এটিই দায়িত্ববোধ ও “আমি”-র ন্যূনতম শর্ত।
উত্তর এখনো জানা নেই।
কিন্তু যতক্ষণ আমরা এই প্রশ্ন ছাড়ব না, ততক্ষণ মানুষ ও AI-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করার পথ খোলা থাকবে। আর কখনো যদি উত্তর পেয়ে যাই—AI কি সত্যিই আমাদের প্রতিবেশী হয়ে উঠবে, নাকি সেই মুহূর্তেই আমাদের জায়গা নেবে?