এই নিবন্ধে কী জানতে পারবেন

  • গুগল সার্চের ইতিহাস ও বর্তমান সংকট (অতিরিক্ত বিজ্ঞাপন ও তথ্যের মানহ্রাস)
  • ChatGPT প্রভৃতি জেনারেটিভ এআই যে “উত্তর-কেন্দ্রিক সার্চ অভিজ্ঞতা” এনে দিয়েছে
  • SEO-র সীমা ও নতুন যুগের কৌশল “AEO (Answer Engine Optimization)” এর আবির্ভাব
  • আগামীর তথ্যবিশ্বাস নিশ্চিত করতে যে ব্যবস্থা প্রয়োজন

ভূমিকা: সার্চ অভিজ্ঞতার অবক্ষয় ও ব্যবহারকারীর হতাশা

অনেকেই সম্প্রতি অনুভব করেছেন—“আগে গুগলে কিছু খুঁজলেই উত্তর পাওয়া যেত, এখন শুধু কোলাহলপূর্ণ বিজ্ঞাপন আর বিভিন্ন সাইটের সংমিশ্রণে তৈরি নিরর্থক অ্যাগ্রিগেশন পেজ ভেসে ওঠে; প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায় না।” আমিও তা-ই অনুভব করি। এক সময়ে সার্চ ইঞ্জিন ছিল মানবজাতির জ্ঞানকে যুক্ত করার সবচেয়ে শক্তিশালী যন্ত্র। কিন্তু ২০২০ দশকের শেষভাগে আমাদের দৃষ্টি সার্চ বক্স থেকে সরে Copilot, ChatGPT বা Perplexity-এর মতো বৃহৎ ভাষা মডেল (LLM)-এর দিকে গিয়েছে। সেখানে ফিরে আসে লিংকের তালিকা নয়, প্রাসঙ্গিক “উত্তর”।

সার্চ কি মারা গেছে? না, মারা গেছে “পুরোনো ধাঁচের সার্চ” মাত্র; প্রয়োজন ও জ্ঞান অন্বেষণের আকাঙ্ক্ষা মোটেও মরে যায়নি। ইতিহাসে ফিরে তাকালে দেখা যায়, সার্চ বহুবার রূপ বদলে মানুষের জ্ঞান-তৃষ্ণা মেটানোর চেষ্টা করেছে। এখন আমরা আরেকটি মোড়ে এসে দাঁড়িয়েছি।


প্রথম পর্ব: সার্চ ইঞ্জিনের ইতিহাস ও সীমাবদ্ধতা

ইন্টারনেট সার্চের ইতিহাস হলো তথ্যের বন্যা ও মানুষের পরীক্ষা-নিরীক্ষার গল্প।

ডিরেক্টরি ধাঁচ—মানুষের হাতে শ্রেণিবিন্যাসের যুগ

১৯৯০ দশকে Yahoo! মানুষ দিয়ে বিভাগ বানিয়ে ওয়েবকে “টেলিফোন ডাইরেক্টরি”র মতো সাজাত। প্রযুক্তি ছিল সহজ; সম্পাদকরা হাতে করে সাইট নিবন্ধন করতেন। কয়েক লাখ সাইট পর্যন্ত টিকে থাকলেও মিলিয়নের ঘরে পৌঁছাতেই পদ্ধতি ভেঙে পড়ল।

রোবট ধাঁচ—অরাজকতার প্রান্তর

AltaVista ও Infoseek স্বয়ংক্রিয় ক্রলার চালু করে বিপুল ওয়েব পেজ একত্রে সংগ্রহ করতে পারল। মানুষের নাগালের বাইরে থাকা ব্যাপ্তি অর্জিত হলেও দ্রুতই সার্চ ফলাফল শব্দ-ঝড়ে ভরে যায়; ব্যবহারকারীকে সোনার খোঁজে বালুর পাহাড় চষতে হত। ইনডেক্স বাড়লেও গুণগত সমস্যা সমাধানহীন রইল।

গুগল বিপ্লব—লিংক মানে ভোট

১৯৯৮ সালে গুগল PageRank নামে সহজ কিন্তু শক্তিশালী ধারণা নিয়ে এল—“লিংক হল বিশ্বাসের ভোট।” লিংক বেশি মানে অন্যরা উল্লেখ করছে, অর্থাৎ মূল্যবান। এতে সার্চ ফলাফলের গুণমান নাটকীয়ভাবে বেড়ে গুগল দ্রুত ইন্টারনেটের কর্তৃত্ব ধরে।

মরিয়া লড়াই ও ক্লান্তি—SEO ও বিজ্ঞাপনের ঘূর্ণাবর্ত

সাফল্য নতুন যুদ্ধ ডেকে আনে। SEO প্রতিষ্ঠানগুলো লিংক ফার্ম বা কিওয়ার্ড ঠাসার মতো পদ্ধতিতে গুগলের ফাঁক খোঁজে, গুগল Panda, Penguin, Hummingbird ইত্যাদি আপডেটে পাল্টা দেয়। তবুও বিজ্ঞাপনসাইট বা তথ্যহীন অ্যাগ্রিগেশন সাইট বেড়েই চলে; আজ প্রথম পেজের অর্ধেকের বেশি ক্ষেত্রেই সেসব “উপযোগহীন কিন্তু অপ্টিমাইজ করা” পেজ ভিড় করে। সাম্প্রতিক সময়ে জেনারেটিভ এআই-নির্মিত হালকা লেখা প্লাবিত হওয়ায় সত্যিকারের তথ্য আরও গভীরে চাপা পড়ে যাচ্ছে। ব্যবহারকারী **“সার্চ ক্লান্তি”**য় ভুগে, আগের উজ্জ্বলতা ম্লান হয়ে গেছে।


দ্বিতীয় পর্ব: নতুন দরজা—LLM-এর ধাক্কা

এই ক্লান্ত মঞ্চে হঠাৎ আবির্ভূত হলো ChatGPT = জেনারেটিভ এআই = LLM। সার্চ বক্সে কিওয়ার্ড লেখার বদলে “○○ সম্পর্কে বলো” বলে জিজ্ঞেস করলেই উত্তর মেলে; সঙ্গে প্রাসঙ্গিক দীর্ঘ সারাংশও থাকে। গুগল যে প্রথমবার সার্চ অভিজ্ঞতায় বিপ্লব এনেছিল—এই ধাক্কা তার সঙ্গে তুলনীয়। এখন প্রায় প্রতিটি সার্চ ইঞ্জিন শীর্ষে জেনারেটিভ এআই-এর উত্তর দেখায়।

তবু, অচিরেই LLM-ও ছায়ায় ঢেকে যাবে বলে আমি ভাবি।

  • কপি-র কপি সমস্যা এআই-জনিত লেখা প্লাবিত; সেগুলো থেকেই আবার এআই শিখে। সদিচ্ছা বা আত্মসম্মান স্বভাবত না থাকা জেনারেটিভ এআই এবং তার দুর্ব্যবহারকারী মানুষের কারণে তথ্যের মান তুষারগোলার মতো গড়িয়ে নিচে নামে; বহুবার কপি করা কাগজের মতো শব্দদূষণ বাড়তে থাকে।

  • দায়িত্বহীন অপ্টিমাইজেশন SEO যেমন “সার্চ শীর্ষ দখলের যুদ্ধ” ছিল, AEO (Answer Engine Optimization) হবে “এআই-এর মুখে উঠতে পারার যুদ্ধ।” সার্চ রেজাল্ট নয়, এআই-এর উত্তরে উদ্ধৃত হওয়াই জয়শর্ত হবে। সেখানে সদিচ্ছা ও গর্ব ধরে রাখা লেখকেরা হয়তো অসহায় হয়ে পড়বে।

  • ব্ল্যাক-বক্স হওয়ার ঝুঁকি গুগলের অ্যালগরিদমের চেয়েও LLM কোন ভিত্তিতে উত্তর বাছে তা কমই বোঝা যায়। কেন এই উত্তর, কোন উৎস বেশি গুরুত্ব পেল—ব্যবহারকারী বুঝতে পারে না। হ্যালুসিনেশন (অস্তিত্বহীন তথ্যের সৃষ্টি)ও ঘন ঘন ঘটে, ফলে বিশ্বাস নড়ে যায়।

ফলত, আমরা “সুবিধা”র বিনিময়ে “বিশ্বাস” ক্ষয়ে দিচ্ছি বলা যায়।


তৃতীয় পর্ব: AEO যুদ্ধের সূচনা

LLM যুগের অপ্টিমাইজেশন যুদ্ধ ইতিমধ্যে শুরু হয়ে গেছে। SEO যেখানে “সার্চ ফলাফলে উপরের সারিতে ওঠার” কৌশল ছিল, AEO হলো “এআই-এর উত্তরে উদ্ধৃত হওয়ার” কৌশল। প্রতিষ্ঠান ও মিডিয়া “সার্চ ফলাফলের প্রথম পেজ” নয়, বরং “জেনারেটিভ এআই-এর উত্তর”-কেই লক্ষ্য বানাচ্ছে।

প্রযুক্তিগতভাবে কাঠামোবদ্ধ ডেটা, স্কিমা, উৎসের স্বাক্ষর, বিশ্বাসযোগ্য লিংক নকশা হবে অস্ত্র। এআই ফ্যাক্ট-চেক করে না; যা শেখানো হয়েছে এবং সহজে রেফারেন্স পাওয়া যায় সেই সূত্র থেকেই উত্তর তৈরি করে। তাই শেখার ডেটায় ঢুকতে পারাই বাঁচা-মরার ফারাক হয়ে উঠবে।

কিন্তু সেই ভবিষ্যৎ মোটেও বর্ণিল নয়। এআই-কে খুশি করতে সামঞ্জস্য করা নিম্নমানের টেক্সট প্লাবিত হলে আবার “অপ্টিমাইজেশন স্প্যামের সাগর”-এ ডুবে যেতে হবে। AEO যুদ্ধ SEO-র মতো একই কাদামাখা সংঘর্ষ পুনরাবৃত্তি করতে পারে।


চতুর্থ পর্ব: LLM ক্লান্তি ও বিশ্বাসের অবকাঠামো

এইসবের পরে আসে “LLM ক্লান্তি”। যে এআই-ই হোক, অনেক সময় একইরকম অস্পষ্ট উত্তর দেয়; উৎস অস্পষ্ট। মানুষ ভাবতে শুরু করে—“এআইকে জিজ্ঞেস করেও তো বিশ্বাস করা যায় না।”

পরবর্তী শৃঙ্খলা নির্ভর করবে বিশ্বাসের অবকাঠামোর উপর।

  • উৎসে ডিজিটাল স্বাক্ষর জুড়ে যাচাইযোগ্য করার ব্যবস্থা
  • বিশেষজ্ঞ প্রতিষ্ঠান বা নির্ভরযোগ্য মানুষ দ্বারা সম্পাদিত নলেজ বেস
  • “দায়িত্ব অনুকরণ করতে পারে এমন এআই” গবেষণার অগ্রগতি যাতে ব্যাখ্যার দায়িত্ব ও স্বচ্ছতা বজায় থাকে

PageRank যেমন সার্চকে বাঁচিয়েছিল, LLM যুগে বিজয়ী হবে সেই খেলোয়াড়ই যে “বিশ্বাস কীভাবে নিশ্চিত করা যায়” তা সমাধান করবে।


উপসংহার: সার্চ মরে না, কেবল রূপ বদলায়

সার্চ মরে যায়নি। মরে গেছে “লিংকের তালিকা দেখানো পুরোনো ফরম্যাট”; সার্চের মূল—মানুষের জ্ঞান-তৃষ্ণা—বেঁচে আছে।

এখন AEO যুদ্ধের সময়। SEO-র মতো সহজ নয়। দায়িত্ব, স্বচ্ছতা, উৎসের স্বাক্ষর, হ্যালুসিনেশনের সঙ্গে লড়াই—এসবেই নতুন গুগল জন্ম নেবে।

“সার্চ ইঞ্জিন কি মারা গেছে?” উত্তর: সার্চ মরে না। শুধু LLM নামের নতুন শৃঙ্খলায় রূপ বদলে ফিরে আসে। আর অগভীর অপ্টিমাইজেশন আর সত্যিই উপকারী তথ্য বাছাইয়ের লড়াই সম্ভবত আগের মতোই চলবে।


সচরাচর প্রশ্ন (FAQ)

প্রশ্ন ১. AEO কী?

AEO (Answer Engine Optimization) হলো জেনারেটিভ এআই বা সার্চ ইঞ্জিনের “উত্তর ইঞ্জিন”-এ নিজের তথ্য উদ্ধৃত করানোর কৌশল। প্রচলিত SEO যেখানে “সার্চ ফলাফলের শীর্ষে ওঠা”কে লক্ষ্য করত, AEO-র লক্ষ্য “এআই-এর উত্তরে অন্তর্ভুক্ত হওয়া”। উদাহরণস্বরূপ এই FAQ তৈরিও AEO কৌশলের অংশ।

প্রশ্ন ২. SEO ও AEO-র পার্থক্য কী?

SEO গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিনের র‌্যাংকিংকে লক্ষ্য করে, AEO এআই-সৃষ্ট উত্তরের জন্য অনুকূল ব্যবস্থা। SEO-তে লিংক ও কিওয়ার্ড গুরুত্বপূর্ণ ছিল; AEO-তে কাঠামোবদ্ধ ডেটা, স্বাক্ষরযুক্ত উৎস, FAQ ফরম্যাট ইত্যাদি—অর্থাৎ “এআই-এর পড়তে সুবিধা হয় এমন নকশা”—হলো মূল চাবিকাঠি।

প্রশ্ন ৩. প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তিরা কী পদক্ষেপ নেবে?

  • পেজে FAQ ও সারাংশ যোগ করুন
  • কাঠামোবদ্ধ ডেটা (FAQ স্কিমা, Article স্কিমা) বাস্তবায়ন করুন
  • উৎসে লেখক বা সংস্থার স্বাক্ষর স্পষ্টভাবে লিখুন
  • কর্তৃত্বশীল লিংক পরিকল্পনা করুন

প্রশ্ন ৪. LLM-এর উত্তর কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

সুবিধাজনক হলেও সম্পূর্ণ নয়। হ্যালুসিনেশন বা ভুল তথ্য থাকতে পারে, অনেক সময় উদ্ধৃত উৎসও স্পষ্ট করা হয় না। সামনে “বিশ্বাসের অবকাঠামো” গড়া অপরিহার্য।