ভূমিকা

জেনারেটিভ AI ও Copilot “মানুষের কাজ কমিয়ে দেয়” এই ধারণায় দ্রুত জনপ্রিয় হয়েছে। রিপোর্ট, কোড সম্পূর্ণ করা, গবেষণা, প্রেজেন্টেশন—যে কাজগুলো একসময় ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাগত, এখন মিনিটেই শেষ হয়।

তাহলে AI যখন হাতের কাজ হালকা করে, মানুষ কিসে ক্লান্ত হয়? আসলেই কি কাজ সহজ হয়ে যায়?

কিছু দল ইতিমধ্যেই উল্টো লক্ষণ দেখছে। ChatGPT-কে প্রশ্ন করলে উত্তর পাওয়া যায়, কিন্তু “কোনটা গ্রহণ করব” এই সিদ্ধান্তের চাপ বাড়ে। Copilot কোড প্রস্তাব দেয়, অথচ “আসলেই সঠিক কি না” যাচাইয়ের সময় কমে না।

অর্থাৎ হাতের কাজ কমে, কিন্তু “বিচার” ও “দায়িত্ব” মানবসত্ত্বাকে ক্লান্ত করে তোলে—এই ভবিষ্যৎ হয়তো আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। এটাই আমি “AI ক্লান্তি” বলছি।


প্রথম অংশ: AI ক্লান্তির ভিতরটা

AI ক্লান্তি বলতে শুধু “AI বেশি ব্যবহার করায় চোখ ব্যথা” বোঝানো হয় না। এর মূলে আছে জ্ঞানগত চাপের স্থানান্তর

সিদ্ধান্ত ক্লান্তি (Decision Fatigue) কী?

AI সবসময় একাধিক বিকল্প সামনে রাখে। মার্কেটিং দলে ChatGPT-কে বিজ্ঞাপনের কপি লিখতে বললে দশটা প্রস্তাব আসে। Copilot-কে কোনো ফাংশন লিখতে বললে কয়েকটি বাস্তবায়ন সামনে আসে।

সুবিধা আছে বটে, কিন্তু প্রতিবার “কোনটা নেব” তা মানুষকেই ঠিক করতে হয়। বেশিরভাগ প্রস্তাব “আধা ঠিক কিন্তু কিছুটা খটকা” বা “ভালো-মন্দের সমন্বয়”—এই ধূসর অঞ্চলে পড়ে।

এই অপরিপূর্ণ সিদ্ধান্ত বারবার নেওয়া—এটাই AI ক্লান্তির প্রথম স্তর।

যাচাই ক্লান্তি (Verification Fatigue) কী?

AI-এর আউটপুট বিশেষভাবে কঠিন কারণ তা খুবই বিশ্বাসযোগ্য দেখায়। নিখুঁত ভাষা, সুন্দর ফরম্যাট—কিন্তু ভেতরে থাকতে পারে ভুল তথ্য বা নজর এড়ানো সিকিউরিটি ঝুঁকি।

মাঠপর্যায়ে “নিশ্চিত হতে সব যাচাই করো”—এই কাজ এড়ানো যায় না, আর ভবিষ্যতে যাচাই ক্লান্তি আরও বাড়বে।

কাজের ক্লান্তি থেকে দায়িত্ব ক্লান্তিতে

আগে ক্লান্তি আসত “টাইপ বেশি”, “স্লাইড বানাতে সময় লাগে”—এসব থেকে। যখন AI কাজের সিংহভাগ কাঁধে নেয়, তখন বাকি থাকে “কোনটা বেছে নেব” ও “দায়িত্ব নেব”।

AI ক্লান্তি হলো দায়িত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত বারবার নেওয়ার ফলে মানুষের অবসাদ।


দ্বিতীয় অংশ: ঐতিহাসিক প্রেক্ষিত—মানুষের ক্লান্তির বিবর্তন

এই পরিবর্তন আকস্মিক নয়; শ্রমের ইতিহাসে এর ধারাবাহিকতা আছে।

  • শারীরিক ক্লান্তির যুগ: কারখানা বা শ্রমে পেশী ও শক্তি সবচেয়ে বেশি খরচ হতো।
  • পুনরাবৃত্ত কাজের ক্লান্তি: হোয়াইট-কলার কাজ ও কম্পিউটার প্রসারিত হলে একই কাজের পুনরাবৃত্তিই ক্লান্তির মূল ছিল।
  • জ্ঞানগত ক্লান্তির যুগ: IT ও স্বয়ংক্রিয়তা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সিদ্ধান্ত ও যাচাইয়ের ভূমিকায় গিয়ে মানসিক চাপ অনুভব করে।
  • দায়িত্ব ক্লান্তির যুগ (AI ক্লান্তি): AI কাজ সামলালে মানুষ বিচার ও ফলাফলের দায়ে ক্লান্ত হয়।

তৃতীয় অংশ: AI ক্লান্তি ঠেকাতে কাজের নকশা

AI ক্লান্তি শুধুই ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় রোধ করা যাবে না। দরকার কাজের ধরন পুনর্নকশা

মেটা-AI—AI দিয়ে AI যাচাই

এক AI-এর আউটপুট আরেক AI দিয়ে পরীক্ষা করানো। স্ট্যাটিক কোড রিভিউ AI বা ফ্যাক্ট-চেক AI ইতিমধ্যেই পরীক্ষামূলকভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

“AI প্রস্তাব দেয় → AI যাচাই করে → মানুষ শুধু চূড়ান্ত নিশ্চয়তা দেয়” এই তিন স্তর সাধারণ হলে বিচার ও যাচাইয়ের চাপ হালকা হবে।

সিদ্ধান্তের কমান্ড চেইন ডিজাইন—কে সিদ্ধান্ত নেবে?

বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে “AI যা প্রস্তাব দেয়, সব মানুষ ঠিক করবে” এই কাঠামোই আছে। এতে ক্লান্তি এক জায়গায় জমে।

আগেভাগে স্পষ্ট করতে হবে কোন অংশ AI-কে দেবেন, কোন অংশ মানুষ রাখবে। কম ঝুঁকির জায়গা AI-এর হাতে দিন, উচ্চ ঝুঁকির ক্ষেত্র মানুষ দেখে।

দলগত বণ্টন—সিদ্ধান্ত এক জনের কাঁধে দেবেন না

AI ক্লান্তি বাড়ে যখন দায়িত্ব এক নেতা বা মালিকের ওপর কেন্দ্রীভূত থাকে। রিভিউয়ের রোটেশন বা ভাগ করে নেওয়া কেবল প্রক্রিয়াগত নয়—এগুলোই মানুষের স্বাস্থ্য রক্ষার ব্যবস্থা।


চতুর্থ অংশ: লিডারশিপ ক্লান্তি নামের চ্যালেঞ্জ

AI ক্লান্তির শেষ ধাপ হয়তো “লিডারশিপ ক্লান্তি”।

AI প্রস্তাব দিতে পারে, পরামর্শ দিতে পারে; কিন্তু “কোথায় যাব” সেটা ঠিক করতে পারে না। সংগঠন বা প্রকল্পের দিকনির্দেশ ও তার দায়িত্ব শেষ পর্যন্ত মানুষের।

নেতাদের সামনে থাকে অগণিত বিকল্প, আর সিদ্ধান্ত নিতে হয় বারবার। AI-এর প্রস্তাব বাতিল করলেও যুক্তি দেখাতে হয়, আর দায়িত্ব সব তাদের কাঁধে জমা হয়।


পঞ্চম অংশ: দর্শনের প্রশ্ন—মানুষ পরের ধাপে কিসে ক্লান্ত হবে?

যদি একদিন AI সিদ্ধান্ত নিতেও সক্ষম হয়, মানুষ তখন কিসে ক্লান্ত হবে?

  • আত্মমর্যাদা, বিশ্বাস, দায়িত্ববোধ—মানুষের অনন্য এই ভিত্তি কি AI অনুকরণ করতে পারবে? দেখুন “জেনারেটিভ AI-তে প্রাণঘাতীভাবে অনুপস্থিত কী”。
  • AI “দায়িত্ব অনুকরণ” শিখলেও ব্যথা বা লজ্জা না পেলে মানুষের অভিজ্ঞতার সমতুল্য কি হতে পারবে?

AI ক্লান্তি দেখিয়ে দেয় মানুষকে এখনও দায়িত্ববান সত্তা হিসেবেই ভাবতে হয়।


উপসংহার

AI কাজ কমায়। কিন্তু বিনিময়ে বিচার ও দায়িত্বের বোঝা বাড়িয়ে দিতে পারে।

“AI ক্লান্তি”-র আসল অর্থ হলো কাজের ক্লান্তি থেকে দায়িত্বের ক্লান্তিতে উত্তরণ।

ভবিষ্যতে প্রয়োজন হবে—

  • মেটা-AI দিয়ে যাচাই স্বয়ংক্রিয় করা
  • কে বিচার করবে, কার কাঁধে দায় থাকবে—এটি পরিষ্কার করা
  • টিমের মধ্যে সিদ্ধান্তের চাপ ভাগ করে নেওয়া
  • লিডারশিপকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করা

শেষ পর্যন্ত মানুষকে ক্লান্ত করে দায়িত্ব কাঁধে নেওয়াই। সে বোঝা কীভাবে ভাগ করবেন, কীভাবে নকশা করবেন—AI যুগে কাজের চেহারা নির্ধারণ করবে সেটাই।


FAQ (প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্ন)

প্রশ্ন: AI ক্লান্তি কী?
উত্তর: AI কাজের বোঝা কমালেও মানুষ “বিচার” ও “দায়িত্ব” নিতেই ক্লান্ত হয়—এই ঘটনাকে বোঝায়।

প্রশ্ন: AI ক্লান্তি কীভাবে রোধ করব?
উত্তর: মেটা-AI দিয়ে যাচাই স্বয়ংক্রিয় করা, সিদ্ধান্ত ও দায়িত্বের রেখা পরিষ্কার করা, টিমভিত্তিক বণ্টন—এগুলো গুরুত্বপূর্ণ।

প্রশ্ন: AI ক্লান্তি কি একেবারে নতুন সমস্যা?
উত্তর: না। মানব ক্লান্তির ইতিহাসে এটি পরের ধাপ। শারীরিক → পুনরাবৃত্ত কাজ → জ্ঞানগত → এখন দায়িত্ব ক্লান্তি।